বাংলাদেশে কাজ পেতে বহুজাতিক কোম্পানি সিমেন্স সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ছেলে আরাফাত রহমান কোকোকে ঘুষ দিয়েছিল। এ ব্যাপারে প্রথম অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় প্রথম আলোয়, ২০০৮ সালের ২২ ডিসেম্বর। আর কানাডীয় কোম্পানি নাইকোর কাছ থেকে কোটি টাকা দামের গাড়ি নিয়েছিলেন খালেদা সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন। ২০০৫ সালের ১৪ জুন প্রথম আলো এ নিয়ে প্রথম অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এরপর প্রতিমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। ওই প্রতিবেদন দুটি আজ আবার ছাপা হলো।
কাজ পেতে কোকোকে ঘুষ দেয় সিমেন্স
ফখরুল ইসলাম ও আব্দুল্লাহ মামুন
খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো জার্মান বহুজাতিক কোম্পানি সিমেন্স এজির স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সিমেন্স বাংলাদেশকে অর্থের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দিয়েছিলেন। এ জন্য কোকোকে কমপক্ষে এক কোটি ২৬ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছিল। প্রতিশ্রুত টাকা দেওয়া হয়নি বলে কোকো অভিযোগ করলে অতিরিক্ত অর্থ হিসেবে ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর সিঙ্গাপুরের ব্যাংক হিসাবে এই অর্থ জমা পড়ে। সিঙ্গাপুরে কোকোর ব্যাংক হিসাবে যে ১১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে, তার মধ্যে এই টাকাও আছে।
চারদলীয় জোট সরকারের আমলে বাংলাদেশের সরকারি মোবাইল ফোন কোম্পানি টেলিটক প্রকল্পের কাজ পায় সিমেন্স ৫৩ লাখ ডলার ঘুষ দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ইতালির তদন্ত এবং সিমেন্স এজির নিজস্ব তদন্তে এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে। মার্কিন আদালতে ঘুষ দেওয়ার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে সিমেন্স বাংলাদেশও। শাস্তিস্বরূপ তাদের পাঁচ লাখ ডলার জরিমানা দিতে হবে। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর মার্কিন আদালত এই রায় দেন। আদালতের এই রায় মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআইয়ের প্রতিবেদনে বিস্তারিত প্রকাশ করা হয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতিবিরোধী অভিযান শুরু হলে অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট বা পারস্পরিক আইনি সহায়তা চুক্তি না থাকার কারণে প্রথম দিকে বাইরে থেকে সাহায্য পাওয়া যায়নি। পরে সরকারের দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগে সাহায্যের ব্যাপারে বিশ্বের অনেক দেশ এগিয়ে এসেছে। সরকার বিভিন্ন দেশ থেকে পাওয়া বাংলাদেশি নাগরিকদের দুর্নীতিসংক্রান্ত তথ্য খতিয়ে দেখার জন্য অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়কে দায়িত্ব দিয়েছে। তারা এ সংক্রান্ত যুক্তরাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর ও ইতালি থেকে বিভিন্ন মামলার নথিপত্র ও তদন্ত প্রতিবেদন পেতে শুরু করে। টেলিটকের কাজ পাওয়ার জন্য সিমেন্স বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ঘুষ দেওয়ার বিষয়টির বিস্তারিত জানা যায় যুক্তরাষ্ট্রের একটি আদালতের কাগজপত্র থেকে। বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির অভিযোগে যুক্তরাষ্ট্রের ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে সিমেন্স এজির বিরুদ্ধে মামলা হয়। এর মধ্যে সিমেন্স বাংলাদেশও রয়েছে। ডিস্ট্রিক্ট জজ রিচার্ড জে লিওনের আদালতে শুনানি চলাকালে মূল প্রতিষ্ঠান সিমেন্স এজি তাদের দোষ স্বীকার করে নেয় এবং ৪৪ কোটি ৮৫ লাখ ডলার শোধ করতে সম্মত হয়। এর মধ্যে সিমেন্স বাংলাদেশের মতো সিমেন্স আর্জেন্টিনা ও সিমেন্স ভেনিজুয়েলাও আছে। এরা প্রত্যেকে পাঁচ লাখ ডলার করে জরিমানা দিতে সম্মত হয়েছে।
মার্কিন কংগ্রেসে পাস হওয়া একটি আইনে বলা হয়েছে, বাইরের দেশে কাজ পেতে কোনো মার্কিন কোম্পানি ঘুষ দিতে পারবে না। সিমেন্স মূলত জার্মান কোম্পানি হলেও তা নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে নিবন্ধিত। সে কারণে সিমেন্স বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ‘দ্য ফরেন করাপ্ট প্র্যাকটিসেস অ্যাক্ট-১৯৭৭’ আইনে মামলা করে যুক্তরাষ্ট্র সরকার। এ মামলার বিবরণে টেলিটকের কাজ পেতে সিমেন্স কী ধরনের অসাধু পন্থা অবলম্বন করেছিল, তার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। কলম্বিয়ার ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে পেশ করা যুক্তরাষ্ট্র সরকারের প্রতিবেদন, ইতালির সরকারি কৌঁসুলির দপ্তর থেকে পাঠানো অনুরোধপত্র ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্যসংবলিত প্রতিবেদন প্রথম আলোর হাতে এসেছে।
২০০৮ সালে ইতালির সরকারি কৌঁসুলি প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে বাংলাদেশ সরকারের কাছে সহযোগিতা চেয়ে অনুরোধপত্র পাঠায়। এটি পাঠানো হয় বাংলাদেশে অবস্থিত ইতালি দূতাবাসকে। সঙ্গে পাঠায় সিমেন্স নিযুক্ত মার্কিন ল ফার্ম দেবেভয়স অ্যান্ড প্লিমটনের তৈরি তদন্ত প্রতিবেদনের সংক্ষিপ্তসার। ইতালি দূতাবাস ওই সংক্ষিপ্তসারসহ অনুরোধপত্রটি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। আর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ মাসের মাঝামাঝি তা পাঠিয়ে দেয় আইন মন্ত্রণালয় ও অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন প্রথম আলোর কাছে সিমেন্স বাংলাদেশের দুর্নীতিবিষয়ক একটি চিঠি পাওয়ার কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কিছু করার নেই। যাদের কিছু করার আছে, তাদের কাছেই তা পাঠানো হয়েছে।’
তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল সালাহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, এটি অত্যন্ত গোপনীয় বিষয়। এ নিয়ে কোনো আলোচনা বা মন্তব্য করতে রাজি নন তিনি।
জড়িত হলেন কোকো ও আমিনুল হক: সিমেন্স ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমল থেকেই টেলিটক মোবাইল ফোন প্রকল্পের কাজ পেতে চেষ্টা চালায়। এ জন্য ফজলে সেলিম ও জুলফিকার আলী নামের দুজনকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয় সিমেন্স বাংলাদেশ। ২০০১ সালের ২৭ মার্চ সিমেন্স ইতালির বাণিজ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা ওই দুই পরামর্শকের সঙ্গে একটি চুক্তি সই করেন। এতে বলা হয়, ফজলে সেলিম ও জুলফিকার আলীর বিভিন্ন প্রকল্পে ১৫ বছরের সফলতার ইতিহাস আছে। সার্বিকভাবে জটিল এ কাজে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দুই রাজনৈতিক দল, দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিতে বিটিটিবির শীর্ষ থেকে নিম্নপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। এ কারণে তাঁরা পরামর্শক ফি সাধারণ কমিশনের তুলনায় বেশি চেয়েছেন। ওই বছরের ২৪ এপ্রিল সিমেন্স বাংলাদেশ ও সিমেন্স ইতালি ওই দুই পরামর্শকের সঙ্গে ব্যবসাসংক্রান্ত কাজের ব্যাপারে তাঁদের কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানায়। সে সময় তাঁদের সঙ্গে মৌখিকভাবে চুক্তি হয় যে প্রকল্পের অর্থের মধ্যে ১০ শতাংশ তাঁদের দেওয়া হবে। যুক্তরাষ্ট্রে মামলার নথিতে এসব তথ্য দেওয়া আছে।
বিটিটিবির সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার আগে টেলিটক প্রকল্পটির জন্য তিনবার খোলা দরপত্র আহ্বান করা হয়। তিনবারই অংশ নেয় সিমেন্স বাংলাদেশ। প্রথমবার কারিগরি অযোগ্যতার কারণে বাদ পড়ে। দ্বিতীয়বার ২০০১ সালে দরপত্র আহ্বান করা হলে তালিকায় নাম ওঠে সিমেন্সের। কিন্তু সদ্য ক্ষমতায় বসা তৎকালীন চারদলীয় জোট সরকার তা বাতিল করে দেয়। অর্থের পরিমাণ পরিবর্তন ও সরবরাহকারীর সংখ্যা কমিয়ে দিয়ে তৃতীয় দরপত্র আহ্বান করা হয় ২০০২ সালে। কিন্তু ২০০২ সালের ১৮ ডিসেম্বর সিমেন্স ওই দরপত্রে যথাযথভাবে সনদ দেখাতে না পারায় অকৃতকার্য হয়।
মার্কিন আদালতে মামলার নথিতে বলা হয়, পরদিন ১৯ ডিসেম্বর সিমেন্স বাংলাদেশের তৎকালীন বাণিজ্য বিভাগের প্রধান খালেদ শামস সিমেন্স ইতালির একজন কর্মকর্তার কাছে ই-মেইলে জানান, ওই সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ফজলে সেলিম ও জুলফিকারের কোনো ক্ষমতা নেই। এ ধরনের প্রকল্পের জন্য অবশ্যই শীর্ষ রাজনৈতিক নেতা, মন্ত্রণালয় এবং বিটিটিবির শীর্ষ ও কারিগরি ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে হবে। ওই দুই পরামর্শকের সঙ্গে টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর ভালো যোগাযোগ নেই।
এ সময় মিজানুর রহমান নামের এক ব্যক্তিকে তৃতীয় পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয় সিমেন্স বাংলাদেশ। তিনি তৎকালীন টেলিযোগাযোগমন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হকের বেয়াই।
২০০৩ সালের শেষ দিকে ব্যারিস্টার আমিনুল হক বিটিটিবির প্রকল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বুঝিয়ে বাতিল দরপত্র সচল করতে সক্ষম হন বলে যুক্তরাষ্ট্রের মামলার নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মন্ত্রী এ সময় সিমেন্সের প্রস্তাব সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত কমিটিতে পাঠাতে বলেন। ২০০৪ সালের ২৬ জানুয়ারি ক্রয় কমিটি সিমেন্সের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। এ সময় ব্যারিস্টার আমিনুল হক খালেদ শামসকে জানান, তিনি সিমেন্সকে একটি ভালো অবস্থানে আনার জন্য বিষয়টি দেশের শীর্ষস্তরে নিয়ে যেতে চান।
মার্কিন তদন্তে জানা যায়, ওই সময়ই আরাফাত রহমান কোকো নির্দিষ্ট কমিশনের (পারসেন্টেজ) বিপরীতে সিমেন্সকে ওই অবস্থা থেকে উদ্ধার করার জন্য খালেদ শামসের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আর আর্থিক বিষয়টি সুরাহার জন্য তাঁরা যোগাযোগ করেন কোকোর প্রতিনিধি সাজিদ করিম নামের এক ব্যক্তির সঙ্গে। সাজিদ করিম দরপত্রে অংশ নেওয়া চীনা কোম্পানি হুয়াইয়ের প্রতিনিধি হিসেবেও কাজ করেন। সিমেন্সের সঙ্গে হুয়াইও টেলিটক প্রকল্পের আংশিক কাজ পায়।
সব ধরনের নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সিমেন্সের দরপত্র পাস হয় এবং ২০০৪ সালের ১৪ জুন বিটিটিবির সঙ্গে তাদের চুক্তি হয়। দরপত্র পাস হওয়ার খবরটি কোকোই প্রথম জানান খালেদ শামসকে।
মার্কিন আদালতের নথিতে বলা হয়েছে, ২০০৫ সালের মাঝামাঝি কোকো ও খালেদ শামসের মধ্যে কথা হয়। এ সময় কোকো তাঁকে প্রতিশ্রুত টাকা দেওয়া হয়নি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। খালেদ ও সিমেন্সের নতুন প্রধান নির্বাহী রুডলফ ক্লিংক কোকোর সঙ্গে দেখা করে আশ্বস্ত করেন যে তাঁরা প্রতিশ্রুত অর্থ দেওয়ার ব্যাপারে আন্তরিক।
২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে পরামর্শক জুলফিকার আলী সিঙ্গাপুরে ইউনাইটেড ওভারসিজ ব্যাংকে (ইউওবি) কোকোর ব্যাংক হিসাবে এক লাখ ৮০ হাজার ডলার পাঠিয়ে দেন।
সিঙ্গাপুরে কোকোর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও সিমেন্সের টাকা: সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রে জানা গেছে, ২০০৪ সালের ১২ এপ্রিল সিঙ্গাপুরের এক নাগরিকের সহযোগিতায় কোকো ওই দেশে জেডএএসজেড ট্রেডিং অ্যান্ড কনসালটিং প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি নিবন্ধন করেন এবং ইউওবি ব্যাংকে হিসাব খোলেন। সিঙ্গাপুরের ওই নাগরিকের সঙ্গে কোকোর পরিচয় করিয়ে দেন কিউসি শিপিংয়ের এক কর্মকর্তা। ব্যাংক হিসাবটি যৌথ হলেও তা থেকে অর্থ তোলার ক্ষমতা ছিল একমাত্র কোকোর। যুক্ত সই কিংবা এককভাবে চেকে কোকো সই করে অর্থ তুলতে পারতেন। সিঙ্গাপুরের ওই ব্যাংকে কোনো বিদেশি নাগরিকের হিসাব খোলার নিয়ম নেই। সে কারণেই ওই নাগরিকের সহযোগিতা নেন কোকো।
লিখিত ওই বক্তব্যে জানা যায়, সিমেন্সের পরামর্শক জুলফিকার আলী ২০০৫ সালের ৬ অক্টোবর কোকোর ওই হিসাবে এক কোটি ২৬ লাখ টাকা (এক লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার) জমা করেন। এর আগে ওই ব্যাংক হিসাবে চায়না হার্বার ইঞ্জিনিয়ারিং নামের একটি প্রতিষ্ঠান ২০০৫ সালের ৬ মে ও ৩১ মে যথাক্রমে নয় লাখ ২০ হাজার ৯৮৬ এবং আট লাখ ৩০ হাজার ৬৫৬ সিঙ্গাপুরি ডলার জমা করে।
২০০৫ সালের ১৮ ডিসেম্বর সংবাদ ব্রিফিংয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন—দুদক জানায়, সিঙ্গাপুর সরকার সে দেশের ব্যাংকে জমা কোকোর ১১ কোটি ৬৬ লাখ টাকা জব্দ করেছে।
সূত্র জানিয়েছে, ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে কোকো সিঙ্গাপুরের ওই নাগরিককে জেডএএসজেডের নামে থাকা হিসাব বন্ধ করে ওই টাকা অন্য একটি ব্যাংকে জমা দিতে নির্দেশ দেন। ওই সময় ক্রেডিট ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাট কমার্শিয়াল (সিআইসি) নামে ফরাসি ব্যাংকের সিঙ্গাপুর শাখায় কোকোর টাকা স্থানান্তর করেন তিনি। তবে এবার ওই হিসাব কোকোর নামে নয়, ওই নাগরিকের নামেই করা হয়। এ সময় ২০ লাখ ১৩ হাজার ৪৬৭ দশমিক ৩৮ সিঙ্গাপুরি ডলার স্থানান্তর করা হয়। তবে গত বছরের নভেম্বরে তিনি ওই অর্থ আবারও আগের ব্যাংকে স্থানান্তর করেন বলে জানা যায়।
তবে সিঙ্গাপুরে জেডএএসজেড নামে কোম্পানি ছাড়াও ফারহিল কনসালটিং প্রাইভেট লিমিটেড নামে কোকোর আরেকটি কোম্পানির সন্ধান পাওয়া গেছে।
২০০৫ সালের ১৯ ডিসেম্বর ইউওবির অন্য একটি শাখায় সিঙ্গাপুরের ওই নাগরিককে হিসাব খুলতে নির্দেশ দেন কোকো। তবে এবার সিঙ্গাপুরের ওই ব্যক্তির নামেই হিসাব খোলা হয়। ২০০৬ সালের ১৭ ও ১৯ জানুয়ারি হিসাবটিতে যথাক্রমে এক লাখ ৪৯ হাজার ৯৮৮ ও এক লাখ নয় হাজার ৯৮৮ মার্কিন ডলার জমা পড়ে। হাবিবুর রহমান নামের এক ব্যক্তি দুবাই থেকে ওই টাকা জমা দেন। এরপর ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি কোকোর নির্দেশে সিআইসি ব্যাংকে ওই টাকা স্থানান্তর করেন।
সিমেন্সের ব্যয় ৩৭ কোটি টাকা: ২০০১ সালের মে থেকে ২০০৬ সালের আগস্ট পর্যন্ত টেলিটক প্রকল্পের কাজ পেতে সিমেন্স অন্তত ৫৩ লাখ ৩৫ হাজার ৮৩৯ দশমিক ৮৩ মার্কিন ডলার বা ৩৭ কোটির বেশি টাকা ব্যয় করে। এ টাকা তিন পরামর্শক সাজিদ সেলিম, জুলফিকার আলী ও মিজানুর রহমানকে দেওয়া হয়। তাঁদের হাত ঘুরে টাকা চলে যায় প্রকল্পসংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিটিটিবির কর্মকর্তাদের কাছে। কিছু টাকা হাতে হাতে তুলে দেওয়া হয় বিটিটিবির কর্মকর্তা বা তাঁদের আত্মীয়দের হাতে।
২০০৩ সালের এপ্রিলে প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সদস্য নাদির শাহ কোরেশীর কাছে ১০ হাজার ডলার, বিটিটিবির অপর এক কর্মকর্তার মেয়ের কাছে পাঁচ হাজার ডলার এবং মন্ত্রী আমিনুল হকের ভাগনের কাছে এক হাজার ডলার তুলে দেয় সিমেন্স। যুক্তরাষ্ট্রে দায়ের করা মামলার নথিতে এ বিষয়গুলোর সুস্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে। সিমেন্স তৃতীয় দরপত্রে সনদসংক্রান্ত ত্রুটির জন্য যে অকৃতকার্য হয়, তার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য অর্থ দেওয়া হয় কোরেশীকে। ২০০২-এর শেষপ্রান্তে কিংবা পরের বছরের শুরুতে বিটিটিবির প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ও বর্তমানে টেলিটকে কর্মরত ইউসুফ নিয়াজকে ১০ হাজার ডলারের বিনিময়ে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় বলে মার্কিন আদালতের নথিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
একই সময়ে কোরেশীর অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যায়ন কমিটির আরেক সদস্যকে সিমেন্স ‘প্রকৌশলী’ হিসেবে নিয়োগ দেয়। ওই প্রকৌশলীর মেয়ের কাছে পাঁচ হাজার ডলার তুলে দেওয়া হয়।
তৎকালীন বিটিটিবির পরিচালক (ক্রয়) নাদির শাহ কোরেশী ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সিমেন্স থেকে এক কানাকড়িও নেননি তিনি। প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির সদস্য ইউসুফ নিয়াজও অর্থ গ্রহণের কথা অস্বীকার করেন।
বিটিটিবির মোবাইল প্রকল্পের কাজ পাওয়ার পর সিমেন্স ২০০৬ সালের ২৩ মার্চ তিন পরামর্শক ফজলে সেলিম, জুলফিকার আলী ও মিজানুর রহমানের জন্য ক্যালিফোর্নিয়ার সানফ্রান্সিসকোতে সিমেন্সের ব্যাংক হিসাব থেকে ৮০ হাজার ডলার করে পাঠায়। এর আগে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বরে মিজানুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং তাঁর হংকংয়ের একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এই অর্থ জমা দেওয়া হয়। (সংক্ষেপিত)
আদালতে ৯৪ লাখ ৯৯ হাজার কানাডীয় ডলার জরিমানা
মোশাররফকে ঘুষ দিয়ে কানাডায় দণ্ডিত নাইকো
সাবেক বিএনপি সরকারের জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনকে ২০০৫ সালে একটি দামি গাড়ি ও ভ্রমণব্যয়ের পাঁচ হাজার ডলার ঘুষ দেওয়ায় স্বদেশে দণ্ডিত হয়েছে কানাডীয় তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কোম্পানি নাইকো রিসোর্সেস।
বাণিজ্যিক স্বার্থে বিদেশে ঘুষ দেওয়া প্রতিরোধসংক্রান্ত কানাডার আইনে সে দেশের একটি আদালতে ২০০৯ সাল থেকে এ মামলা চলছিল। নাইকো দোষ স্বীকার করায় গত শুক্রবার ওই আদালত দণ্ড হিসেবে ৯৪ লাখ ৯৯ হাজার কানাডীয় ডলার (৯৭ লাখ ৫০ হাজার ৭৯৪ মার্কিন ডলার) জরিমানার আদেশ দেন। ৩০ দিনের মধ্যে এ জরিমানা পরিশোধ করতে হবে।
ইন্টারনেটে কানাডীয় ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম থেকে পাওয়া খবরে জানা যায়, আদালত আগামী তিন বছর নাইকোর কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করবেন বলেও আদেশে বলা হয়েছে। তবে সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেন আগের মতোই গতকালও অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
গতকাল শনিবার মোশাররফ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি কোনো অন্যায় করিনি। কানাডার আদালতে মামলার ব্যাপারেও আমি কিছু জানি না। নাইকোকে সুবিধা দেওয়ার অভিযোগে তো বর্তমান ও সাবেক দুই প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকের বিরুদ্ধে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলা হয়েছিল। তাতে তো তাঁরা দোষী বলে প্রমাণ হয় না।’
২০০৫ সালের জানুয়ারি মাসে ছাতকের টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডের পর, বাপেক্সের মাধ্যমে মোশাররফ হোসেনের জন্য তখনকার দামে প্রায় ৮৫ লাখ টাকার একটি টয়োটা ল্যান্ড ক্রুজার সিগনাস (২০০৫ মডেল) গাড়ি পাঠায় নাইকো। গাড়িটি ২৩ মে জ্বালানি প্রতিমন্ত্রীর বাসায় আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়।
প্রতিমন্ত্রীর পক্ষে গাড়িটি গ্রহণ করার সময় এ-সংক্রান্ত নাইকোর দাপ্তরিক নথিতে লেখা হয়, ‘মাননীয় প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের বাসভবনে প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে পাশে বর্ণিত জিনিসপত্র নাইকোর প্রতিনিধির নিকট হতে বুঝিয়া পাইলাম’। গাড়ি ছাড়াও নথিতে পাশে বর্ণিত জিনিসপত্র হচ্ছে, গাড়ির অস্থায়ী ব্লু বুক, ফিটনেস সার্টিফিকেট, মূল বিমা সার্টিফিকেট, টুলবক্স, একটি অতিরিক্ত চাকা, একটি বিকল্প চাবি, অপারেটরস ম্যানুয়াল প্রভৃতি।
এ ব্যাপারে ২০০৫ সালের ১৪ জুন প্রথম আলোতে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তখন মোশাররফ হোসেন প্রতিমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বাধ্য হন। খবরটি প্রকাশের সময় প্রতিমন্ত্রী কানাডা ও আমেরিকা সফরে ছিলেন। ওই সফরের ব্যয়ভারও নাইকো বহন করেছে বলে কানাডীয় আদালতে বলা হয়েছে। কিন্তু তখন নাইকোর পক্ষ থেকে ঘুষ দেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলা হয়েছিল, যৌথ অংশীদার হিসেবে বাপেক্সকে গাড়িটি দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, প্রথম আলোর খবরের প্রতিবাদ পাঠিয়েছিল নাইকো। কানাডার গণমাধ্যমের কাছেও নাইকোর তৎকালীন শীর্ষ কর্মকর্তা ঘুষ দেওয়ার কথা অস্বীকার করেছিলেন।
প্রতিমন্ত্রী সফর থেকে ১৮ জুন (২০০৫) শনিবার ভোরে দেশে ফিরে ওই দিন সকালে সাংবাদিকদের বলেন, তাঁর ও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ঘুষ নেওয়ার মিথ্যা অভিযোগ তুলে সরকারকে বিব্রত করার চেষ্টা হচ্ছে। তিনি কোনো অন্যায় করেননি। এরপর ওই দিন সন্ধ্যায়ই তিনি ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেন। অবিলম্বে তা গৃহীতও হয়।
ওই বছরই নাইকো গাড়িটি ফিরিয়ে নেয়। ফলে তখনই প্রমাণ হয়ে যায়, গাড়িটি বাপেক্সকে দেওয়া হয়নি। যৌথ অংশীদার হিসেবে বাপেক্সের ব্যবহারের জন্য দিলে সেটি আর ফিরিয়ে নেওয়া হতো না। তা ছাড়া টেংরাটিলা, ফেনী ও কামতা গ্যাসক্ষেত্রের যৌথ অংশীদারি চুক্তির কোনো শর্তেই বাপেক্সকে নাইকোর গাড়ি দিতে হবে এমন শর্ত ছিল না।
এ প্রেক্ষাপটে কানাডীয় আদালতের রায়ের পর সে দেশের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট জেমস কট্জ গণমাধ্যমকে বলেন, আদালতের এ রায়ের পর কোম্পানিগুলো এখন আর এমনটি ভাববে না যে, অপরাধ করেও পার পাওয়া যাবে।
আদালতে নাইকোর পক্ষের আইনজীবী বলেন, নাইকোর মতো কোম্পানির পক্ষে প্রায় ৯৫ লাখ ডলার জরিমানা দেওয়া কোনো বড় বিষয় নয়। তবে আদালতের দণ্ডাদেশ কোম্পানিটির ভাবমূর্তির ওপর এক বড় আঘাত।
এদিকে, টেংরাটিলা বিস্ফোরণের জন্য নাইকোর কাছে দাবি করা ক্ষতিপূরণের বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক আদালতে আছে। নাইকো যখন ক্ষতিগ্রস্ত গ্যাস কাঠামোর জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে গড়িমসি করছিল, তখন বিগত সরকারের আমলে পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) হাইকোর্টে একটি রিট মামলা দায়ের করেছিল। সেই মামলার রায়ে আদালত সরকারকে বলেছিলেন, ক্ষতিপূরণ না দেওয়া পর্যন্ত নাইকোকে ফেনী ক্ষেত্র তোলা ও সরবরাহ করা গ্যাসের দাম পরিশোধ করা যাবে না।
এরপর নাইকো ফেনী থেকে গ্যাস সরবরাহ করলেও দাম পরিশোধ করা হচ্ছিল না। একপর্যায়ে তারা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে চেষ্টা চলে ক্ষতিপূরণ আদায় ও গ্যাস সরবরাহ শুরু করার ব্যাপারে মতৈক্যে পৌঁছার। কিন্তু তা হচ্ছিল না। এরপর নাইকো বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে।
No comments:
Post a Comment